মেয়র লোকমান হত্যায় অবশেষে মন্ত্রীর ছোট ভাই সহ ১৪ জনকে আসামি করে মামলা ।। শুধু হল না ট্রেন পুড়িয়ে দেওয়া মামলা

বিএনপি নিউজ ২৪ প্রতিবেদক,নরসিংদী: নরসিংদীর মেয়র লোকমান হোসেনকে হত্যার দায়ে টিঅ্যান্ডটি মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য রাজিউদ্দিন আহমদ রাজুর ছোট ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে হুকুমের আসামি করে ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। নরসিংদী সদর মডেল থানায় মামলাটি করেন নিহত লোকমানের ভাই কামরুজ্জামান। হত্যাকাণ্ডের ৫০ ঘণ্টা পর গতরাত সাড়ে ১০টায় মামলা রুজু হয়। একজন বাদে অপর আসামিরাও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। এরা হলেন—জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক পৌর চেয়ারম্যান আবদুল মতিন সরকার, মোবারক হোসেন মোবা, নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ভূইয়া, নূরুল ইসলাম, মনোয়ার হোসেন, টিঅ্যান্ডটি মন্ত্রীর এপিএস মাসুদুর রহমান মুরাদ, যুবলীগ নেতা কবীর সরকার, যুবলীগ নেতা আশরাফুল ইসলাম সরকার, ছাত্রলীগ নেতা ও নরসিংদী কলেজের সাবেক ভিপি মিয়া মোহাম্মদ মনজুর প্রমুখ। সালাউদ্দিন বাচ্চুও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা।
এছাড়া তারেক আহমেদ নামের বিএনপির বিদ্রোহী গ্রুপের নেতাকেও আসামি করা হয়েছে। মামলা নং ৬।
দাফন কাফন নিয়ে ব্যস্ততা, নিহতের পরিবার সদস্যদের মানসিক অবস্থা ভালো না থাকা—মামলা দেরির কারণ হিসেবে বলা হলেও, বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে—টিঅ্যান্ডটি মন্ত্রীর পরিবার সদস্যকে আসামি করার ক্ষেত্রে জেলা আওয়ামী লীগের প্রবল বাধায় ঘটে এ বিলম্ব। থানায় দিনভর চলে নানামুখী চাপ ও দেন-দরবার। থানার ওসি মামলা নিতে চাননি প্রথমে। বাদীপক্ষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে টালবাহানা করা হয়। বলা হয়—আগে উপরের সঙ্গে কথা বলে দেখি। তারপর ভেবে দেখা যাবে মামলা নেয়া যায় কিনা। নিহত মেয়রের পরিবার সদস্যদের আর্জিকে আমলেই নিতে চাননি থানার লোকজন। এ ফাঁকে অন্য তত্পরতাও চলে। টোপ দেয়া লোকমানের পরিবারকে। বলা হয়—মিটমাট ও ফয়সালায় আসতে। নিহত মেয়রের পরিবারের কোনো সদস্যকে মেয়র করার আশ্বাসও দেয়া হয় মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের তরফ থেকে। শেষ অবধি মামলা দায়েরে সফল হন কামরুজ্জামান।
এদিকে গতকাল সকালে মেয়রের বাসভবন থেকে বের হয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান বলেন, লোকমান হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মন্ত্রী ও তার ভাই কোনোভাবেই জড়িত থাকতে পারে না। এ সময় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, যেখানে মেয়রের পরিবার থেকে মন্ত্রী ও তার ভাইকে এ খুনের জন্য দায়ী করা হচ্ছে সেখানে আপনি মন্ত্রীর পক্ষে সাফাই গাইছেন কেন। তখন তাড়াহুড়ো করে আমি কিছু জানি না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যান তিনি।
লোকমান হোসেনের জনপ্রিয়তার কারণে এই সভাপতিও গত দুই বছর যাবত্ লোকমানের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। সভা সমাবেশেও মেয়রকে খাটো করে নানা কটূক্তি করতেন তিনি। আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আসাদুজ্জামানসহ আওয়ামী লীগের বেশ কিছু সিনিয়র নেতা লোকমানের জনপ্রিয়তাকে রীতিমত ভয় পেতেন; এবং তাদের অনেকেরই শঙ্কা ছিল লোকমান আগামী সংসদ নির্বাচনে সদস্য পদে নির্বাচন করলে তাকে ঠেকানো যাবে না।
এদিকে মন্ত্রী হওয়ার পর নরসিংদীতে রাজিউদ্দিন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকায় ক্লিন ইমেজের নেতা লোকমানের অনুসারীরা তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। এমনকি জুতা ও ঝাড়ু মিছিলও বের করে তারা। মন্ত্রী রাজু পুরো বিষয়টির দায় চাপান লোকমান হোসেনের ওপর; এবং এলাকাবাসীর অনেকেরই ধারণা এসব কারণে মন্ত্রী ও তার ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুর প্রত্যক্ষ মদতে লোকমানকে হত্যা করা হয়েছে।
শহর ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও যুবলীগ নেতা আলমগীর মোল্লা জানান, নরসিংদীর রাজনৈতিক অঙ্গনে লোকমান হোসেনের উত্থানে আওয়ামী লীগপাড়া হিসেবে খ্যাত শহরের বেপারিপাড়ার নেতাদের রাজনৈতিক শক্তি খর্ব হতে থাকে। এরই জের ধরে লোকমান হোসেনের সঙ্গে বেপারিপাড়ার নেতাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এরই সঙ্গে যোগ হয় জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর সঙ্গে মতবিরোধ।
নরসিংদী সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আঙ্গুর মোল্লা জানান, জেলা ছাত্রলীগ ও নরসিংদী সরকারি কলেজের ছাত্ররাজনীতি ছিল মেয়রের নিয়ন্ত্রণে। এক বছর আগে কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেলে মেয়রের ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয় লাভ করেন। শামীমসহ ছাত্রলীগের মনোনীত পূর্ণ প্যানেলকে পরাজিত করার জন্য মন্ত্রী রাজু ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা চরম বিরোধিতা করেন। কিন্তু ছাত্রসংসদ নির্বাচনে শামীমসহ ১৩ জন জয়লাভ করেন। পাশাপাশি পৌর নির্বাচনে লোকমান হোসেন ২২ হাজার ভোটের ব্যবধানে ফের মেয়র নির্বাচিত হন।
ধীরে ধীরে মন্ত্রীর সঙ্গে মেয়রের সম্পর্ক এতটাই বিরোধপূর্ণ হয় যে, মন্ত্রী যে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উপস্থিত থাকেন, তাতে মেয়র লোকমান অংশ নেন না। এ পর্যন্ত চার থেকে পাঁচবার এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়। এমনকি সম্প্রতি নরসিংদী সরকারি কলেজ মাঠে পৌর প্রশাসন যে বাণিজ্যমেলার আয়োজন করে, তা মন্ত্রীকে অগ্রাহ্য করে করা হয় বলে প্রশাসনের তোপের মুখে পড়েন মেয়র লোকমান হোসেন। এছাড়া কয়েকদিন আগে মন্ত্রী নরসিংদী শহরে নবনির্মিত ডাকঘর ভবন উদ্বোধন করলেও সেখানে মেয়রকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের আগামী কাউন্সিলর সম্ভাব্য সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী নিয়ে আলোচনা চলছিল। পৌর মেয়র লোকমান হোসেন তার ঘনিষ্ঠজনের কাছে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরই অংশ হিসেবে এরই মধ্যে তিনি জেলার বিভিন্ন উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন তিনি।
অন্যদিকে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুর নামও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছিল।
নিহত লোকমান হোসেনের ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও নরসিংদী সরকারি কলেজের ভিপি শামীম নেওয়াজ বলেন সম্প্রতি ছাত্রলীগ নেতাদের বিরম্নদ্ধে মন্ত্রীর নির্দেশে মামলা হওয়ার পর আপনাদেও কাছে বলেছিলাম নরসিংদীতে প্রতিহিংসার রাজনীতি চলছে। আর সেই রাজনীতিই আমার ভাইকে খুন করেছে।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মাস্টার বলেন, লোকমান হোসেন একজন ন্যায়বিচারক ও অত্যন্ত জনপ্রিয় মানুষ ছিলেন। তার মৃত্যুতে তিনি গভীরভাবে শোকাহত ও মর্মাহত উল্লেখ করে বলেন, এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার ঠেকাতে এখনও ষড়যন্ত্র চলছে। তাই অহেতুক বিএনপিকে জড়ানোর জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চলছে বলে দাবি করেন।
ওয়াকিবহাল মহল জানান, এখন এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার- দলীয় কোন্দলের জেরে নরসিংদীবাসী হারিয়েছেন তাদের প্রিয় তরুণ মেয়র লোকমান হোসেনকে।
এদিকে নির্মম এই হত্যাকাণ্ড-উত্তর নৈরাজ্যে দেশের সম্পদহানি কোটি কোটি টাকার। একমাত্র রেলওয়েরই ক্ষতি ৫০ কোটি টাকার বেশি। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের আগুনে এগারসিন্দুুর এক্সপ্রেসের ৯টি বগিই পরিত্যক্ত। আরও ৫টি শিগগির আর যাত্রীসেবায় আসতে পারছে না। নরসিংদী রেলস্টেশনের সিগন্যাল সিস্টেম ভস্মীভূত হয়ে অকার্যকর। খোদ রেলস্টেশনের চারদিকে ধ্বংসের নানা চিহ্ন। রেলওয়ে তাই সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করেছে স্টেশনটি। ট্রেনের বগিতে লেলিহান আগুন দেয়ায় বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীদের মাঝেও তীব্র আতঙ্ক। ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে ট্রেন শিডিউল।
মিডিয়ার কল্যাণে দেখা ও জানা এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখে দেশবাসীর চোখে ঘুম নেই। কিন্তু দিব্যি কুম্ভকর্ণ ঘুমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সরকার। প্রভাবশালী মন্ত্রী পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা হলেও নিহত পরিবার সুবিচার পাবে কিনা, তা অনিশ্চিত। নানা চাপের মুখে লোকমান পরিবার ও থানা প্রশাসন। রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারে থেকে সরকারি দলের কোন্দলের পাপে নির্মম-নিষ্ঠুর হত্যার পর সরকারি দল কর্মীদের এই নৈরাজ্য তাণ্ডব ইতিহাসে বিরল। সরকারি আগুনেই এখন পুড়ে ছাই জনগণের অর্ধশত কোটি টাকার অমূল্য সম্পদ। এসবের জেরে ঈদে ঘরমুখো ট্রেনযাত্রীর ভোগান্তি চরমে।
নজিরবিহীন নাশকতা নিয়ে চলছে লোকদেখানো প্রহসনের অপরাধী পাকড়াও নাটক। আওয়ামী লীগের কয়েকশ’ নেতাকর্মীর চোখের সামনে মেয়র লোকমান ব্রাশফায়ারে খুন হলেও কেউ এগিয়ে যায়নি খুনিদের ধরতে বা ঠেকাতে। পুলিশ-গোয়েন্দারা এখনও পারেনি খুনিদের পাত্তা-পরিচয় খুঁজে বের করতে। কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি তারা। খুঁজে পাচ্ছে না প্রকাশ্য দিবালোকের খুনিদের। থানায় দায়ের মামলা নিয়েও চলছে নানা চক্রান্ত। এই প্রহসনে ‘কোরবানি’ করার ষড়যন্ত্র চলছে বিরোধী দল নেতাকর্মীদের। এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে নরসিংদী জেলা বিএনপি সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনকে। প্রতিবেশী লোকমান গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন শুনে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেলে। বাসায় ফিরতে না ফিরতেই আটক করা হয় তাকে।
গত বছর অক্টোবরে খালেদা জিয়ার সিরাজগঞ্জ জনসভায় সাধারণ মানুষের ওপর ট্রেন তুলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল সাতজনকে। সে সময় তার তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল সিরাজগঞ্জবাসী। তখন কোনো বিলম্ব ছাড়াই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তুমুল অ্যাকশনে নেমেছিলেন। জনতার ক্ষোভ বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর বর্তিয়ে শীর্ষ নেতাসহ ৫ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৬টি মামলা দিয়ে ব্যাপক ধরপাকড় করা হয়। কায়েম করা হয় ত্রাসের রাজত্ব। আর এবার উল্টো চিত্র। সরকারি দলের শত শত নেতাকর্মীর চোখের সামনে দিয়ে খুনিরা সদর্পে স্থান ত্যাগ করলেও পুলিশ তাদের টিকিটিও ধরতে পারছে না। আগুন দিয়ে অর্ধকোটি টাকার সম্পদহানি ঘটালেও সরকার সমর্থক দাঙ্গা-নৈরাজ্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেই।
এত বড় ঘটনার দু’দিন পার হয়ে গেলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ও যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বা তাদের কোনও প্রতিনিধি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেননি।
পর্যবেক্ষকরা স্মরণ করছেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের লাগাতার অবরোধের সময় স্থানীয় নেতারা ট্রেনের ওপর তাণ্ডব চালিয়েছিল।
নরসিংদীতে সরেজমিনে দেখা গেছে নরসিংদী রেলস্টেশনের সিগন্যাল সিস্টেম ভস্মীভূত হয়ে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। রেলস্টেশনের দেয়ালগুলো এতটাই দগ্ধ হয়েছে যে লাল ইট বেরিয়ে এসেছে। অবকাঠামোগত ও টেকনিক্যাল সিস্টেম নষ্ট হয়ে যাওয়া নরসিংদী রেলস্টেশনটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে রেলওয়ে। ফলে এ স্টেশনে রেলক্রসিং করার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেল। একইসঙ্গে এই এলাকায় রেলের গতি ৪৮ কিলোমিটার থেকে দুই-তৃতীয়াংশে কমিয়ে ১৬ কিলোমিটার বেগে চালাতে চালকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-কিশোরগঞ্জ ও ঢাকা-নোয়াখালী রুটে চলাচলকারী রেলের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হবে। রেলের শিডিউল বিপর্যয় আরও বাড়বে। এদিকে রেলে আগুন ও ক্ষয়ক্ষতির জন্য রেল বিভাগের কর্মকর্তাদের অদূরদর্শিতা দায়ী বলে মনে করছেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। নরসিংদীর উত্তাল হওয়ার খবর জানার পরও নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কেন তারা ওই রুটে রেল চালিয়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তারা। এছাড়া ট্রেনটি পুড়িয়ে দেয়ায় আগাম বিক্রি করা তিন হাজার টিকিট যাত্রীদের ফেরত দেয়া হয়েছে। চারটি ট্রিপ বন্ধ থাকায় ২০ হাজার যাত্রী ভোগান্তিতে পড়েছেন। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে গতকাল আলাপ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন গতকাল বলেছেন, নরসিংদীতে ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ১৪টি কোচের মধ্যে ৯টি কোচের ক্ষতি হয়েছে। এগুলো মেরামত করতে প্রায় দুই কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। ওই ঘটনায় রেল চলাচলে বিলম্ব হচ্ছে। তবে দু-এক দিনের মধ্যে তা স্বাভাবিক হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলা নিয়ে লুকোচুরি করছে রেল বিভাগ ও পুলিশ প্রশাসন। স্টেশন ও রেলে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের ভয়াবহ হামলার ঘটনায় গতকাল ভৈরবের জিআরপি থানায় একটি মামলা করা হয়েছে বলে গতকাল আমার দেশ-কে জানান, রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আবু তাহের ও এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান মো. মিজানুর রহমান। মো. আবু তাহের জানান, এ ঘটনায় ৬ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মো. মিজানুর রহমান জানান, ভৈরবের জিআরপি থানায় একটি মামলা হয়েছে। আরও একটি মামলার প্রক্রিয়া চলছে। তবে রেলওয়ের স্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন উল্টো কথা। স্টেশন মাস্টার মরণ চন্দ্র দাস, নরসিংদী সদর থানা, ভৈরব থানা ও জিআরপি থানার ওসি জানান, কোনো মামলা হয়নি। ভৈরবের জিআরপি থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তা এএসআই কামাল গতকাল রাত ৯টায় জানান, আমাদের কাছে মামলা করতে কেউ আসেননি। তবে শুনেছি, মামলার প্রক্রিয়া চলছে। এ বিষয়ে জানতে গতকাল রাতে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ফোন করা হলে তারা রিসিভ করেননি।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, নরসিংদী পৌরসভার মেয়র খুন হওয়ার পরই মঙ্গলবার রাতে শহরের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। তারা রেল স্টেশনের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালায় ও অগ্নিসংযোগ করে। কন্ট্রোল রুমে আগুন লাগিয়ে দেয়। ছাত্রলীগ নরসিংদীতে তিন দিনের হরতালের ডাক দেয়। নরসিংদী রেলস্টেশনে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা তদন্তে রেলওয়ের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমানকে প্রধান করে ৬ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। হরতাল চলাবস্থায় নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত না করেই কমিটির সদস্যরা বুধবার এগারসিন্দুর রেলে চড়ে ঘটনাস্থলে যান। ওই সময় বিক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ নেতারা এগারসিন্দুর রেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। রেল বিভাগের কর্মকর্তারা ফ্যালফ্যাল চোখে তা দেখতে থাকেন। তবে রেলচালকসহ কয়েকজন কর্মকর্তার সহায়তায় রেলের ইঞ্জিনটি বগি থেকে আলাদা করে নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। রেল বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, অগ্নিকাণ্ডের এ ঘটনায় সরকারের প্রায় ৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। একটি নতুন বগি আমদানি করতে ভ্যাটসহ দাম দাঁড়ায় ৬ কোটি। পুড়ে যাওয়া পুরাতন বগিগুলোর দাম চার কোটির বেশি। এ হিসেবে ৯টি বগিতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা। এছাড়া সিগন্যাল সিস্টেম পুড়ে যাওয়ায় ৬-৭ কোটি টাকা ও রেলস্টেশনের স্থাপনায় নষ্ট হওয়ায় ৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে সরকারের অর্ধশত কোটি টাকার লোকসান হলো। এছাড়া নরসিংদী স্টেশনটি বন্ধ হয়ে গেল। এটি নিয়ে রেলওয়ের ১৩৮টি স্টেশন বন্ধ। পাশাপাশি রেল চলাচলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সৃষ্টি হবে। টেন্ডারসহ সব প্রক্রিয়া শেষ করার পর নতুন বগি আমদানি করতে এক থেকে দেড় বছর সময় ব্যয় হয়। সরকারের পরিকল্পনায় শিগগিরই বগি আমদানির সম্ভবনা নেই বলেও জানান তারা।
নরসিংদীতে ট্রেনে আগুন দেয়া ও পরবর্তী পরিস্থিতি সরেজমিন পরিদর্শন করেন রেলওয়ের পরিচালক (ট্রাফিক) সরদার সাহাদাত আলী। গতকাল আমার দেশ-কে দেয়া সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, এগারসিন্দুর ১৪টি বগি নিয়ে যাচ্ছিল। স্থানীয়রা আগুন ধরিয়ে দিলে ৯টি বগি ভস্মীভূত হয়ে গেছে। বাকি ৫টি বগির একটির সিটসহ অন্যান্য জিনিস আগুনে পুড়ে গেছে। অবশিষ্ট বগিগুলোতে ভাংচুর চালানো হয়েছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, পুড়ে যাওয়া ৯টি বগি হয়তো পরিত্যক্ত হয়ে যাবে। কারণ আগুনের লেলিহান শিখায় সব পুড়ে শুধু ট্রেনের বডি পড়ে আছে। এগুলোর টেম্পার কমে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া বিক্ষুব্ধরা স্টেশনে ভাংচুর ও আগুন দেয়ায় পুরো স্টেশন পুড়ে গেছে। তবে রেল কর্মকর্তারা ইঞ্জিনটি সরিয়ে ফেলায় তা রক্ষা পেয়েছে বলেও জানান তিনি।
রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক (অপারেশন) মো. মিয়াজাহান বলেন, বিক্ষুব্ধরা শুধু ভাংচুর চালালে খুব বেশি একটা সমস্যা হতো না। কিন্তু তারা রিলে রুম অর্থাত্ কন্ট্রোল রুম জ্বালিয়ে দিয়েছে। এতে সত্তর দশকে আনা রিলে ইন্টার লকিং সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে। এর ফলে ওই রুটগুলোতে চলাচলকারী ট্রেনগুলোকে কন্ট্রোল করা, সিগন্যাল ও নির্দেশনা এবং ক্লিয়ারেন্স দেয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ফলে রিলে রুমের দেয়ালের উপরিভাগ পুড়ে উঠে গেছে। সেখানে ইট দেখা যাচ্ছে। রেল চলাচলে বিঘ্ন ঘটবে জানিয়ে মিয়াজাহান বলেন, নরসিংদী স্টেশনে কোনো ক্রসিং থাকবে না। রেলগুলো নরসিংদীর আগে-পরে আমিরগঞ্জ ও ঝিনারদি স্টেশনে ক্রসিং করতে হবে। ওই অঞ্চলে ট্রেনের গতি আগে ৪৮ কিলোমিটার ছিল। সিগন্যাল সিস্টেম না থাকায় ওই এলাকায় রেলের গতি কমিয়ে ১৬ কিলোমিটার বেগে চলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যাত্রী ও রেলচালকরা স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। তবে মাঝপথে রেল থামিয়ে যাত্রী তোলা ও নামিয়ে দিতে পারবে।
ট্রেনের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আবু তাহের গতকাল আমার দেশ-কে বলেন, এটা স্থানীয় মানুষের তাণ্ডব। তাদের হামলায় বেশ কয়েকটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নরসিংদী স্টেশনে রেলক্রসিং করতে পারবে না। এতে সময় বেশি লাগবে। রেলের শিডিউল বিপর্যয় ঘটবে। তিনি আরও বলেন, ওই রুটে রেল চলাচলে নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছি। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে নিরাপত্তা চেয়েছি। তারা ব্যর্থ হলে রেল বন্ধ করে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। তিনি আরও বলেন, ওয়ার্কশপে থাকা বগি দিয়ে এ ট্রেনটি যত দ্রুত সম্ভব চালু করা হবে।
নরসিংদীতে ভাংচুর ও আগুনের নিন্দা জানিয়েছেন অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া : নরসিংদীতে পৌর মেয়র হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রকৃত খুনিদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি’র গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া। একই সঙ্গে তিনি প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে বিএনপি নেতা খায়রুল কবীর খোকনকে গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়েছেন। অবিলম্বে খায়রুল কবির খোকনের মুক্তি দাবি করে তিনি বলেন, সরকার নিজের দলের কোন্দল সামাল দিতে না পেরে বিরোধী দলকে নিপীড়ন করছে।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নরসিংদীতে আওয়ামী লীগের তাণ্ডবের ঘটনার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের চরিত্র এর মাধ্যমেই উন্মুক্ত করেছে।

 

Free Web Hosting